মেহেদী ব্যবহার করার বিধান: মেহেদি ব্যবহার বিষয়ে মানুষের মাঝে নানা ধরনের ভূল ধারণা চালু আছে। কেউ কেউ মনে করেন, পায়ে মেহেদি দেওয়া হারাম যেহেতু আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) চুল ও দাড়ি মোবারকে মেহেদী ব্যবহার করতেন আমরা এমন সকল প্রশ্ন উত্তর জানার চেষ্টা করব।
শুরুতেই আমরা জেনে নিব ইসলাম নারীদের মেহেদি ব্যবহারে সম্পূর্ণরূপে অনুমতি প্রদান করেছে। শুধু তাই নয়, স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য স্ত্রীকে সজ্জিত হতে ইসলাম উৎসাহীত করা হয়েছে।

বর্তমান সমাজে মেহেদির ব্যবহার ব্যাপকভাবে সকল ধর্মের মানুষের মাঝে বেড়ে চলেছে। অনুষ্ঠান বা যে কোন আয়োজন উপলক্ষেও আমাদের মাঝে মেহেদি ব্যবহারের প্রচলন দিনি দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন কি শুধু নারীরাই নয় এখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নানা সময় নানা কাজে মেহেদী বা মেহেদীর রং ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে নারীরা হাত, পায় অথবা চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য মেহেদির রং বেছে নিচ্ছেন। পুরুষরাও চুল ও দাড়ির অকালপক্বতা রোধে কিংবা সৌন্দর্য বৃদ্ধির অংশ হিসেবে মেহেদি ব্যবহার করছেন। প্রশ্ন হলো, মেহেদি বা এর রং ব্যবহারে ইসলামী শরিয়াহ’র নির্দেশনা কী?
বহুল আলোচিত এ বিষয়টিতে শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের বেশ কয়েকটি অভিমত পাওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে সবাই একমত যে, নারীদের জন্য মেহেদি ব্যবহারে কোনো রূপ বিধিনিষেধ নেই। তবে মনে রাখতে হবে, সর্বাবস্থায় মাহরাম নয়, এমন পুরুষের সামনে যাওয়া নারীদের জন্য নিষিদ্ধ।
নারীরা হাত, পা কিংবা চুলের সৌন্দর্য বাড়াতে মেহেদি ব্যবহার করতে পারবেন। হাদিসে এসেছে, এক মহিলা হযরত আয়শা (রা.)-এর কাছে মেহেদি লাগানো বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাবে বলেন, এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে রাসুল (সা.) মেহেদির ঘ্রাণ অপছন্দ করতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪১৬৪)
এবার আসা যাক পুরুষের মেহেদি ব্যবহারের বিষয়ে। ইসলামী শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরুষের জন্য মেহেদি ব্যবহার সম্পূর্ণ হারাম। ছেলে বাচ্চাদের জন্যও এটি নিষিদ্ধ। আবু হুরাইরাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, পুরুষের সুগন্ধি এমন হবে যার সুগন্ধ প্রকাশ পায় কিন্তু রং গোপন থাকবে এবং নারীর সুগন্ধি এমন হবে যার রং প্রকাশ পায় কিন্তু সুগন্ধ গোপন থাকবে। (তিরমিজি, হাদিস ২৭৮৭)
হাতে বা পায়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পুরুষদের মেহেদি ব্যবহার করার অনুমতি নেই। তবে কোনো কোনো শরিয়াহ বিশেষজ্ঞের মতে, চিকিৎসার পথ্য হিসেবে পুরুষের জন্য মেহেদি ব্যবহারের অনুমতি আছে। পুরুষরা চাইলে মাথায় খেজাব ব্যবহার করতে পারবে।
শরিয়াহ এটি সমর্থন করে। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ইহুদি খ্রিস্টানরা যেহেতু খেজাব ব্যবহার করে না তাই তোমরা খেজাব ব্যবহার করে। বুখারি, ২:৮৭৫, বাবুল খেজাব। আবু দাউদ, ২: ৫৭৮, বাবুন ফিল খেজাব
চুল ও দাড়িতে মেহেদী ব্যবহারে রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশনা
মক্কা বিজয়ের পর হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.)-এর পিতা হযরত আবু কোহাফা (রা.) যখন রাসুল (সা.)-এর সামনে এলেন তখন তার চুল-দাড়ি সব একেবারে ধবধবে সাদা অবস্থায় ছিল অর্থাৎ চুল-দাড়ি ছিল ছাগামার (কাশফুলের) ন্যায় শুভ্র। তখন নবীজী তাকে বললেন, কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙের খেজাব ব্যবহার করো। এ ছাড়াও হযরত আবুবকর ও হযরত ওমর (রা.) খেজাব ব্যবহার করেছেন মর্মে হাদিসে আলোচনা পাওয়া যায়। রাসুল (সা.) নিজে খেজাব ব্যবহার করেছেন কি না, এটি নিয়ে হাদিস ব্যাখ্যাতাদের মতভেদ আছে। যেহেতু দুজন বিখ্যাত সাহাবি ও ইসলামের অন্যতম খলিফা থেকে খেজাব ব্যবহার করার বিষয়টি প্রমাণিত তাই এই বিষয়ের ওপর আমল করতে আমাদের আর কোনো সমস্যা নেই।
খেজাব ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, জাফরান রঙের খেজাব ব্যবহার করা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) জাফরান রঙের খেজাব ব্যবহার করেছেন বলে প্রমাণিত আছে। তবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়, যেখানে এসেছে, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মেহেদি রং এবং গাঢ় লাল এবং হলুদ রঙের খেজাব ব্যবহার করা পছন্দ করতেন।
হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ ফতহুল বারিতে তাবরানি শরিফের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি হাদিস এসেছে। সেখানে দেখা যায়, রাসুল (সা.) আনসারি সাহাবিদেরকে
লাল রঙের খেজাব ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করা শরিয়াহর দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসুলে
আকরাম (সা.) কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। হাদিসে এসেছে, যারা কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করবে তারা জান্নাতের খুশবো থেকেও বঞ্চিত হবে। আবু দাউদ ২: ৫৭৮
নারীরা কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করতে পারবে কি নাÑ এ নিয়েও শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের একাধিক মতো পাওয়া যায়। ইসলামী ফেকাহ জগতের প্রখ্যাত মনীষী ইমাম ইসহাক (রহ.) বলেছেন, নারীরা স্বামীদের খুশি করার উদ্দেশে সাজসজ্জার উপকরণ হিসেবে কালো রঙের খেজাব ব্যবহার করতে পারবে। হানাফি মাজহাবের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাতা ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)-এর মতে, স্ত্রী যদি যুবতী হয়, তাহলে স্বামীর জন্য কালো খেজাব ব্যবহার করার অনুমতি আছে। ফতোয়ায়ে আলমগীরী, ৫:৩৭
আরও পড়ুনঃ
চুল ও দাড়িতে মেহেদী ব্যবহারে রাসূল (সাঃ)-এর আমল :
ওছমান বিন আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, ‘আমরা উম্মে সালামার বাড়িতে প্রবেশ করলে তিনি আমাদেরকে নবী করীম (সাঃ)-এর চুল বের করে দেখালেন। আমরা দেখলাম, সেটা মেহেদী ও কাতাম ঘাস দ্বারা রঞ্জিত ছিল’।
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, ‘নবী করীম (সাঃ) সিবতি চামড়ার তৈরি জুতা পরিধান করতেন এবং ওয়ার্স ঘাস ও জা‘ফরান দ্বারা নিজের দাড়িকে হলুদ রঙে রঞ্জিত করতেন। ইবনু ওমরও অনুরূপ করতেন’। এ হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর দাড়িতে খেযাব লাগাতেন।
ইবনু ওমর (রাঃ)-এর আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, যায়েদ ইবনু আসলাম (রহঃ) বলেন, ‘ইবনু ওমর (রাঃ) তাঁর দাড়িতে হলুদ রঙের খেযাব লাগাতেন। এতে তার কাপড়েও ঐ রঙ লেগে যেত। তাকে প্রশ্ন করা হ’ল, আপনি হলুদ রঙ ব্যবহার করেন কেন? তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এ রঙ ব্যবহার করতে দেখেছি এবং তাঁর নিকট এর চেয়ে প্রিয় অন্য কোন রঙ ছিল না। তিনি দাড়িতে খেযাব লাগানোর সময় তাঁর কাপড়ে, এমনকি পাগড়িতেও এ খেযাবের রঙ লেগে যেত’।
আবু রিমছা (রাঃ) বলেন, একদা আমি আমার পিতার সঙ্গে নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট যাই। নবী করীম (সাঃ)-এর কানের লতি পর্যন্ত দীর্ঘ বাবরী চুল মেহেদীর রঙে রঞ্জিত ছিল এবং তাঁর পরিধানে ছিল দু’টি সবুজ রঙের চাদর’। মুহাম্মাদ বিন আক্বীল বলেন, ‘আমি আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর নিকটে রাসূল (সাঃ)-এর খেযাব লাগানো চুল দেখেছি’।
অপরদিকে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত একাধিক হাদীছে রাসূল (সাঃ)-এর খেযাব ব্যবহার না করার ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন- মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) বলেন, ‘আমি আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, নবী করীম (ছাঃ) কি খেযাব লাগিয়েছেন? তিনি বললেন, বার্ধক্য তাকে অতি সামান্যই পেয়েছিল’।
ইবনু সীরীন (রহঃ) আরো বলেন, আনাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হ’ল, ‘রাসূল সাঃ) কি খেযাব লাগাতেন? তিনি বললেন, তিনি তো তেমন বার্ধক্য দেখেননি। তবে ইবনু ইদরীস (রহঃ) বলেন, তিনি [আনাস (রাঃ)] যেন কম বুঝাচ্ছিলেন। অবশ্য আবুবকর ও ওমর (রাঃ) মেহেদী এবং কাতাম ঘাস দ্বারা খেযাব লাগিয়েছেন’।
আবু হুমাইদ বলেন, আনাস বিন মালেক (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, ‘রাসূল (সাঃ) কি খেযাব লাগিয়েছিলেন? তিনি বললেন, না। বার্ধক্য তার সৌন্দর্যহানি করতে পারেনি। তাকে বলা হ’ল, হে আবু হামযা! এটা কি সৌন্দর্যহানি? তিনি বললেন, তোমাদের প্রত্যেকে এটা (চুল-দাড়ি সাদা হয়ে যাওয়াটা) অপসন্দ করে থাকে। আবুবকর (রাঃ) মেহেদী ও কাতাম ঘাস দ্বারা এবং ওমর (রাঃ) মেহেদী দ্বারা খেযাব লাগাতেন’
অন্যত্র এসেছে, ‘আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাঃ)-এর মাথায় এবং দাড়িতে বিশটির বেশি চুল পাকা ছিল না। আর আবুবকর (রাঃ) মেহেদী দ্বারা খেযাব লাগাতেন এবং ওমর (রাঃ) মেহেদী ও কাতাম ঘাস দ্বারা মিশ্রিত খেযাব লাগাতেন’।
উভয় বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য মুহাদ্দিছীনে কেরাম বলেন, আনাস (রাঃ) হয়ত রাসূল সাঃ)-এর অধিকাংশ দাড়ির দিকে লক্ষ্য করে খেযাব ব্যবহারের বিষয়টি নাকচ করেছেন। কেননা রাসূল সাঃ)-এর গুটিকয়েক দাড়ি বা চুল সাদা হয়েছিল। সেই গুটিকয়েক সাদা চুলে তিনি খেযাব ব্যবহার করেছেন। আনাসের নিকট রাসূল (সাঃ)-এর খেযাব লাগানো দাড়ি মওজুদ থাকাটা এটিই প্রমাণ করে। সেটার কথাই ইবনু ওমর (রাঃ) বলেছেন। আবার অধিকাংশ চুল যা কালো ছিল সেগুলোতে খেযাব লাগাননি বিধায় আনাস (রাঃ) তা নাকচ করেছেন। ইবনু ওমর, উম্মে সালামা এবং আবু রামসাহ (রাঃ) থেকে খেযাব লাগানোর বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনার এই মর্মই নিতে হবে। অথবা যারা বলছেন, রাসূল সাঃ) খেযাব ব্যবহার করেননি তাদের কথার উদ্দেশ্য হবে খেযাব ব্যবহার রাসূল সাঃ)-এর নিয়মিত অভ্যাস ছিল না। বরং মাঝে-মধ্যে ব্যবহার করতেন।] সেজন্য ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, ‘গ্রহণীয় মত হ’ল তিনি কোন কোন সময় মেহেদী ব্যবহার করেছেন এবং অধিক সময় মেহেদী ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন। ফলে প্রত্যেকে যা দেখেছে তাই বর্ণনা করেছেন। আর এ ব্যাপারে প্রত্যেক বর্ণনাকারীই সত্যবাদী’
আরও পড়ুনঃ